এস এম আলমগীর চাঁদ :
শহরে প্রবেশের মুখেই চোখে পড়বে দৃশ্যটি। সবুজ ঘাসে ছেয়ে থাকা দোগাছী ইউনিয়নের রাজাপুরে ঢাকা-পাবনা মহাসড়ক সংলগ্ন বিশাল মাঠের মধ্যে মাথা তুলে আছে কয়েকটি ভাঙা ইটের লাল রঙের দেয়াল আর কংক্রিটের কয়েকটি খুঁটি৷ যেন বিধ্বস্ত পুরাকীর্তি। ওপরের দিকে খাঁজকাটা আকৃতি দেখে বোঝা যায়, কোনো একটি কারখানা ছিল এক কালে। ওপরে ছাদ উধাও। জানালা-কপাটের জায়গায় কেবল চতুষ্কোণ শূন্যতা। মূল ভবনটির পাশ দিয়ে আরও যে কয়েকটি ভবন ছিল তার দেয়ালগুলো পর্যন্ত নেই। আছে কেবল ঢালাই করা মেঝে। এখন অবশিষ্ট মূল ভবনটির দেয়ালের ইটগুলোও লোপাট হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। অথচ এখানে ২৪ ঘণ্টা পাহারায় আছেন সাতজন আনসার। এটি ছিল এক কালের বিখ্যাত ক্যালিকো কটন মিল। পাবনার ক্যালিকো কটন মিলে তুলা থেকে উন্নত মানের সুতা উৎপন্ন হতো। সারা দেশের বস্ত্র তৈরির কারখানায় ক্যালিকোর সুতার কদর ছিল দারুণ। মিলটিতে এক হাজার ৫০০ যন্ত্রে সুতা তৈরি হতো। এখন সেই কারখানার অস্তিত্বের সাক্ষী দিচ্ছে কেবল কয়েকটি ভাঙা দেয়াল। চামচিকার দল আর লক্ষ্মীপ্যাঁচা বাসা করেছে তার ফাঁকফোকরে। পুরোনো দিনের কথা: ক্যালিকো কটন মিল নিবন্ধিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। মোট ৩৬ দশমিক ৭২ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত এই কারখানাটিতে উৎপাদন শুরু হয়েছিল পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৮ সালের ১১ নভেম্বর থেকে। এখানে ৪৮০ জন নিয়মিত শ্রমিকসহ প্রায় ৮০০ শ্রমিক কাজ করতেন। কারখানা ভবন ছাড়াও ছিল তুলা ও সুতা রাখার গুদাম, প্রশাসনিক ভবন, কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের পৃথক আবাসিক ভবন, মসজিদ, শহীদ মিনার ইত্যাদি যা এখনো চোখে পড়ে। প্রতিষ্ঠাতা বৃহত্তর পাবনার সিরাজগঞ্জের ইলিয়াস আলী। তিনি একটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ মহাসড়কের অপর পাশে সেটি এখন এমপিওভুক্ত উচ্চ বিদ্যালয়। ক্যালিকো কটন মিলের একমাত্র টিকে থাকা প্রশাসনিক ভবনটিতে এখন আনসার ক্যাম্প। একটি কক্ষে মালিকপক্ষের প্রতিনিধির বসার জায়গা। দেলোয়ার হোসেন নামের এই প্রতিনিধির কাছ থেকেই জানা গেল মিলের আদ্যোপান্ত। ইলিয়াস আলী ও তাঁর আত্মীয়দের তিন পরিবারের নয় জন পরিচালক মিলে কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খুবই লাভজনক ছিল। ১৯৭২ সালের ২৬ শে মার্চ এটিকে জাতীয়করণ করে পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনকে। তারা ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত কারখানাটি চালিয়ে দুই কোটি ৮৭ লাখ দুই হাজার ৫৭০ টাকার ব্যাংক ঋণসহ লোকসানি হয়ে পড়া কারখানাটি আগের মালিক পক্ষ কে ফেরত দিয়ে দেয়। জমিসহ পুরো কারখানাটির বন্ধক চলে যায় ঋণদাতা অগ্রণী ব্যাংক পাবনার আবদুল হামিদ রোড শাখার কাছে। কারখানা ফেরত পেয়ে মালিকপক্ষ নতুন করে এক কোটি ৪০ লাখ টাকার ব্যাংক ঋণ নেয়। কিন্তু লোকসানি এই প্রতিষ্ঠানটি চালানোর চেষ্টা করে আগের সাফল্য আসেনি। মালিকপক্ষের মধ্যেও ছিল মত বিরোধ। এর সুযোগে শ্রমিকদের মধ্যে দলাদলি ও অসন্তোষ দেখা দেয়। একপর্যায়ে ১৯৯৩ সালে কারখানাটি লে-অফ ঘোষণা করা হয়। অপমৃত্যু ঘটে একটি ঐতিহ্যবাহী কারখানার। মামলা-মোকদ্দমা: কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পর সুদে-আসলে ১৬ কোটি ৯০ লাখ টাকার দাবি করে মামলা ঠুকে দেয় ব্যাংক। কারখানা পরিদর্শনে গেলে মালিক প্রতিনিধি দেলোয়ার হোসেন জানান, আইনি লড়াইয়ের দীর্ঘ ইতিহাস। সারমর্ম হলো: নিম্ন আদালত মালিকদের পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। ব্যাংক উচ্চতর আদালতে আপিল করেছে। সেই মামলা চলছে। এর মধ্যে ব্যাংক ২০০৭-০৮ সালে কারখানার গুদামে রাখা তুলা, সুতা ও মেশিন তুলে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে প্রায় ৬১ লাখ টাকা উশুল করেছে। এর পর থেকে শুরু হয়ে যায় লুটপাট। যে যেভাবে পেরেছে মেশিন থেকে শুরু করে দরজা-কপাট খুলে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেছে৷ এখন দেয়ালের ইট পর্যন্ত খুলে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে ছিঁচকে চোর ও মাদকসেবীরা। ব্যাংক অবশ্য তাদের এই বন্ধকি সম্পত্তি পাহারা দেওয়ার জন্য সাতজন আনসার রেখেছে সার্বক্ষণিক। তাদের অবস্থা ঠুঁটো জগন্নাথের মতো। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছেন লুটপাটের দৃশ্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আনসারেরা জানালেন, প্রতিদিন বিকেল থেকেই এখানে মাদকসেবীদের জমজমাট আড্ডা বসে। তারাই এখন কারখানার ইট কাঠ খুলে নিয়ে যাচ্ছে। এর আগে নিয়ে গেছে দরজা-জানালা ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিস। বাধা দিতে গেলে তারা আনসারদের অস্ত্রের মুখে ক্যাম্পে আটকে রাখে। মারধরও করে। আনসারদের সম্বল দুই হাত বাঁশের লাঠি। এ ব্যাপারে অগ্রণী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার ব্যবস্থাপক এ কে এম সালমান শরিফ জানালেন, প্রায় ১৬ কোটি টাকার মামলা চলছে। মূল ঋণ আড়াই কোটি টাকার মতো মতো। আলোচনা করে সুদ কমানোর সুযোগ আছে। তাঁরা মালিকপক্ষের সঙ্গে বসে সমেঝাতায় আসার চেষ্টা করেছিলেন, যেন জায়গাটি একটি স্বনামখ্যাত বড় প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দায় দেনা মিটিয়ে ফেলা যায়৷ শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এখনো তাঁরা মালিক পক্ষকে বলছেন আদালতের বাইরে আলোচনা করে ১০ কোটি টাকা দিয়ে বিষয়টি রফা করে ফেলতে। মালিকপক্ষ তাতে রাজি হচ্ছে না। ব্যাংক কর্মকর্তা আরও জানালেন, নিয়মরক্ষার জন্য নিরাপত্তার লোক রাখতে হয়, তাই আনসার রাখা। আসলে আনসারদেরও কিছু করার নেই। সেখানে কোনো সীমানা প্রাচীর নেই, থাকার ভালো ব্যবস্থাও নেই। ওই পরিবেশে আনসারদের হাতে অস্ত্র দিলে যারা চুরি-ছিনতাই করছে, তারা অস্ত্রও ছিনিয়ে নেবে। এই আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ তাদের কোনো অস্ত্র দেয়নি। যদি চালু হয়: কারখানাটি আবার চালু করার কথা ভাবছেন কি না, জানতে চাইলে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি দেলোয়ার হোসেন বলেন, মামলা নিষ্পত্তি হলে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এই জায়গা কী হবে। এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জানা গেছে, নয়জন মালিকের মধ্যে মাত্র দুজন এখন বেঁচে আছেন৷ তাঁরা হলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হান্নান ও পরিচালক খালিদ হোসেন খান৷ ক্যালিকো কটন মিলের প্রবীণ শ্রমিক আবদুল করিম জানান, শ্রমিকেরা সব সময়ই স্বপ্ন দেখেন মিলটি আবার চালু হবে। অনেকে স্বপ্ন দেখতে দেখতে মারাও গেছেন। মিলটি চালু হলে আবার এলাকাটি কোলাহলপূর্ণ হবে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। মিল বন্ধ হওয়ার পর আবদুল করিম একটি ছোট্ট মুদি দোকান করছেন৷ তবে মিলের বেশির ভাগ শ্রমিক রিকশা চািলয়ে ও তাঁতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন বলে জানালেন তিনি৷ ‘‘শ্রমিকেরা সব সময়ই স্বপ্ন দেখেন, মিলটি আবার চালু হবে। অনেকে স্বপ্ন দেখতে দেখতে মারাও গেছেন। মিলটি চালু হলে আবার এলাকাটি কোলাহলপূর্ণ হবে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
যশোর থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল দৈনিক যশোরের দর্পণ নিয়মিত পড়ুন ও বিজ্ঞাপন দিন
Copyright © 2024 দৈনিক যশোরের দর্পণ. All rights reserved.